জয়িতা-বান্দরবান ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অথিতিগণ
এম.বশিরুল আলম,লামা(বান্দরবান) প্রতিনিধি : মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর বান্দরবান জেলা কর্মকর্তা সুস্মিতি খীসা জানায়, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক উত্তম চর্চা সমূহের মধ্যে “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” শীর্ষক কার্যক্রম একটি অন্যতম। জয়িতা হচ্ছে সমাজের সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নারীর একটি প্রতিকী নাম। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দিক নির্দেশনায় ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে প্রতিবছর আর্ন্তজাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ (২৫ নভেম্বর হতে ১০ ডিসেম্বর) এবং বেগম রোকেয়া দিবস (৯ ডিসেম্বর) উৎযাপন কালে দেশব্যাপী “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” শীর্ষক একটি অভিনব প্রচারাভিযান শুরু হয়েছে।
এ কার্যক্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তৃণমূলের সফল নারী, তথা জয়িতাদের অনুপ্রাণিত করবে। সমগ্র সমাজ মানস নারী বান্ধব হবে এবং এতে করে সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ ত্বরান্বিত করবে। সরকারের উদ্দেশ্য; সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের জয়িতাদের চিহ্নিত করে তাদের যথাযথ সম্মান, স্বীকৃতি ও অনুপ্রেরণা প্রদান করে সমাজের আপামর নারীদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করা এবং তাঁদের জয়িতা হতে অনুপ্রাণীত করা। নারীর অগ্রযাত্রায় সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে জয়িতাদের অগ্রসর হওয়ার পথ সুগম করা।
ফলশ্রুতিতে জেন্ডার সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের মাধ্যমে দেশের সুষম উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা। আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবসের মূল চেতনার সাথে সঙ্গতি রেখে গতানুগতিকতার উর্ধে উঠে দিবস গুলো যথাযথ ভাবে উদযাপন করা। বর্তমান সরকার নারীর গুরুত্ব অনুধ্বাবন করে সকল সেক্টরে তাদের যথাযথ অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন গভেষণামূলক কর্মকান্ড অব্যাহত রেখেছেন। এ কর্মকান্ডের একটি হচ্ছে জয়িতা নির্বাচন। উপজেলা-জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে এই পাঁচ সফল জয়িতার সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত তুলে ধরা হলো।
বিভীষিকাময় সময় উত্তরণে সফল জয়িতা শাহনাজ পারভীন : নির্যাতনের বিভীষিকা মূছে ফেলে নতুন জীবন শুরু করে দৃষ্টান্ত স্ঞান করেছেন। নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলার বাশারি ইউনিয়নে নিভৃত এক পাহাড়ী পল্লীতে যার জন্ম। তার বাবার নাম মতিউর রহমান, মাতা সাহিদা বেগম; জম্ম ১৯৬৭ সালে। ৮০’র দশকের মাঝামাঝিতে লামা উপজেলায় তার বিয়ে হয়। স্বামী কর্তৃক চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে অবশেষে দু’জনের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। পুরুষ শাসিত নিষ্ঠুর সমাজ বাস্তবতার শিকার এই নারী। বিভীষিকাময় জীবন তেকে নিজেকে রক্ষা করে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ৪ ছেলে মেয়েকে বড় করে, ২ মেয়েকে পাত্রস্থ করেন। ছোট মেয়ে চট্টগ্রামের একটি কলেজে মার্ষ্টাস-এ অদ্যয়নরত আছেন। ২ ছেলেও আত্মকর্মী।
শাহনাজ পারভীনের কর্ম নিষ্ঠতায় তিনি ১৯৯৭ সালে লামা সদর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হয়ে ৫ বছর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
তিনি ২০০০ সালে মাতামুহুরী মহিলা সমিতি নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে; একই বছর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত হন। সমাজ উন্নয়নে; বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ, যৌতুক প্রথা বন্ধ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধসহ নারী বন্ধব কর্মসূচীতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
এছাড়া তিনি গৃহিনীদের পারিবারিক কর্মবসরে সুচি শিল্পর (নকশীকাথাঁ) তৈরি করে নারী বান্ধব কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন। এর স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি লামা উপজেলা- বান্দরবান জেলায় জয়িতা নির্বাচিত হয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে চলতি সেশনে মনোনীত হন।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সফল জয়িতা আলেয়া আক্তার মনি : বান্দরবান সদরে সাঙ্গু উপত্যকায়- ৪ নং সুয়ালক ইউনিয়নের সুলতানপুর ১নং ওয়ার্ডে এক দরিদ্র পরিবারে ১লা এপ্রিল ১৯৮৯ সালে জম্ম গ্রহন করেন। তাঁর বাবার নাম আলী আহমেদ। স্বামীসহ সন্তানাদি নিয়ে বর্তমানে শহরের ৮নং ওয়ার্ড হাফেজ গোনা গ্রামে বসবাস এই জয়িতা নারীর। স্বামী- আল ফয়সাল বিকাশ সংবাদ কর্মি, ১৯৯৯ সালে ৬ মে তারিখে তাদের বিবাহ হয়। ২ কণ্যা সন্তানের জননী আলেয়া আক্তার; বান্দরবান সরকারি কলেজে বিবিএ ৩য় বর্ষে অধ্যয়নরত।
সংসার জীবনে পড়া লেখার পাশাপাশি তিনি একজন নারী উদ্যাক্তা, বিউটিশিয়ান ও সমাজ উন্নয়ন কর্মি। পরিবার-সমাজে নারীরা বোঝা নয়; উন্নয়ন সংগ্রামে পশ্চাৎপদতাকে জয় করে পল্লী গ্রামের নারীরাও আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জনে গর্বিত অংশিদার; এমনটি প্রমান করলেন জয়িতা আলেয়া আক্তার মনি।
ছোট বেলায় বাবার ২য় সংসার থাকায় তাদের তিন ভাই-বোনের প্রতি ছিল পিতার বৈরি সূলভ আচরণ। চাকুরী জীবি মায়ের সীমিত রোজগার দিয়ে চলতো সংসার। ১৯৯৯ সালে ৭ম শ্রেণিতে পড়–য়া আলেয়া আক্তারের বাল্যকালে বিয়ে হয়। তার স্বামী সাংবাদিক আল ফয়সাল বিকাশ-এর সীমিত আয় ছিল। বিয়ের দেড় বছরের মধ্যে তাদের কোলজুড়ে প্রথম কণ্যা সন্তান আসে। নবজাতক শিশুর চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করতে হীমশিম; বিভিন্ন জনের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। সেই হতাশা; বঞ্ছনা আর দৈন্যতার চরম আঘাত আলেয়া আক্তার মনিকে শক্তি যুগিয়েছে দারিদ্রতার বিরুদ্ধে সংগ্রামী হতে। “হে দারিদ্র মোরে করেছে মহান” আলেয়া আক্তার কবি নজরুল-এর এই মহান উক্তিটিকে হ্নদয়ে ধারণ করে স্বামীর সহমতে বান্দরবান যুব উন্নয়নের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সেলাই ও হাঁস-মুরগী পালন টেনিং নেন। একই সময় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পূণরায় সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন তিনি।
এর পর কারিতাস এনজিও’র সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সাপ্তাহে ৫ টাকা স য়ের ভিত্তিতে সমিতি গঠন করেন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা, নারী উদ্যাক্তা,-সমাজে নারী ক্ষমতায়ন বিষয়ে বেশ কিছু প্রশিক্ষণ করেন। এরই মধ্যে তাঁর নেতৃত্বে বান্দরবান সদর উপজেলায় তিন হাজার সদস্য নিয়ে “সার্বিক মহিলা উন্নয়ন সংগঠন” নামের একটি সংগঠন সৃষ্টি হয়; এর সভানেত্রি হিসেবে তিনি ৬ বছর দায়িত্ব পালন করেন। ওই সংগঠনের মাধ্যমে এলাকায় পিছিয়ে পড়া নারীদেরকে আয়বৃদ্ধি মূলক কাজে উৎসাহ যোগানোসহ, বাল্য বিবাহ-বহু বিবাহ রোধ, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে প্রচারাভিযান চালিয়ে সমাজ-চেতনা জাগিয়ে তুলে।
বর্তমানে তিনি মাসিক আয় করেন-৫৫ হাজার টাকা, বার্ষিক- ৬লাখ ষাট হাজার টাকা এবং তাঁর স্বামীর মাসিক আয় ২৫ হাজার টাকা; বার্ষিক তিন লাখ টাকা। তাদের স্বামী স্ত্রীর বার্ষিক আয় তর্বমানে- ৯ লাখ ষাট হাজার টাকা। সূতরাং অর্থনৈতিকভাবে এ নারী এখন সাফল্য অর্জনকারী হিসেবে জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। সমাজ-সংসারের কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবেলা করে জীবন সংগ্রামে নিয়োজিত এই জয়িতা নারীরা ইতিহাস হয়ে থাকবে; এমন মন্তব্য এলাকাবাসীর।
সফল জননী নারী মোছাম্মৎ খালেদা বেগম : জেলার আলীকদম উপজেলায় সদর ইউনিয়নস্থ্য খুইল্যা মিয়া পড়ায় জম্ম গ্রহন করেন। তাঁর বাবার নাম আ: শুক্কুর। অত্যান্ত দরিদ্র কৃষক পরিবারে তাঁর জম্ম হয়। ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া লেখা করার পর ১৯৮৩ সালে পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাঁশ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলীর সাথে তার বিবাহ হয়। ৩ ছেলে ১ মেয়ের জননী এই নারী ২০০৬ সালে স্বামীর মৃত্যুতে বিধবা হয়। স্বামী মৃত্যুর পর থেকে নানান প্রতিকুলতা আর অনটন তাকে ধাওয়া করতে থাকে। এই অসহায় বিধবা নারীর লক্ষ হচ্ছে একটাই; সন্তানদেরকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করবেন।
তাঁর পরিশ্রম-মানসিক শক্তি আর আত্মবিশ্বাস ঠিকই কাঙ্খিত লক্ষ্যে তিনি পৌঁছে যাবেন। গরু-ছাগল পালন, গাভীর দুধ বিক্রি, ক্ষেতে-খামারে কাজ করে জীবনযুদ্ধে তার অনবধ্য প্রচেষ্টায় ছেলে-মেয়েদেরকে পড়া লেখা শিখাচ্ছেন।
বর্তমানে তার বড় ছেলে চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ে অর্থনৈতিক বিভাগে অধ্যয়নরত আছেন। ২য় ছেলে ৮ম শ্রেণিতে, ৩য় ছেলে ৭ম শ্রেনিতে এবং একমাত্র মেয়েটিও ৪র্থ শ্রেণিতে লেখাপড়া বরছেন।
একজন সফল জননী নয় শুধু সার্থক মা হিসেবেও তাকে সমাজ-রাষ্ট্র পুরুস্কৃত করা দরকার। এই নারীই প্রমান করতে চলেছে; একজন মায়ের সচেতনতা আর দায়িত্বশীলতাই একটি সুন্দর সুশীল জাতি গড়ে উঠতে পারে। আলীকদমের খালেদা বেগমকে এবছর সফল জননী হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ট জয়িতা মনোনীত করে আর্থিক অনুদান দিয়ে তার সন্তানদের লেখাপড়ার দায়িত্ব সরকারি-বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠান-এর নিকট বহন করার দাবী করা যেতে পারে। তিনি ২০১৬ সালে সফল জননী হিসেবে উপজেলা সীমানা পেরিয়ে জেলা পর্যায়ে মনোনীত হয়েছেন।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস